২০২১ সালের মার্চ মাসের এক শনিবার রাত। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় টিভি চ্যানেল “Channel 9” এর সিডনি কার্যালয়ের কম্পিউটারগুলো হঠাৎ অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। কম্পিউটারগুলোতে কেউ ঠিক মতো কাজ করতে পারছিল না। ইমেইল এবং এডিটিং সিস্টেমগুলো অচল হয়ে পড়ে। ভবনের নেটওয়ার্কও স্থবির হয়ে যায়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ পর্যায়ে যায় যে পরদিন রবিবার সকালে Channel 9 এর জনপ্রিয় টিভি শো “Weekend Today” প্রচার করা যায় নি। অবশেষে রবিবার বিকেলে Channel 9 তাদের টুইটার (বর্তমান X) অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে জানায় যে তারা সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে কর্মীদের অফিসের নেটওয়ার্কের বাইরে বাসায় বসে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ব্যবহৃত যে কোন কম্পিউটার বা ডিভাইস অন/অফ/রিস্টার্ট করতে নিষেধ করা হয়। বাঘা বাঘা আইটি স্পেশালিস্টদের কাজে লাগিয়ে অবশেষে সোমবার সকাল নাগাদ “বিধ্বস্ত” Channel 9 চালু হয়।
কী হয়েছিল Channel 9 অফিসে ?
তাৎক্ষণিক কোন অফিসিয়াল বিবৃতি না দিলেও ধারণা করা হয় Channel 9-এ ঘটে যাওয়া হামলাটি Malware হামলা। এটি খুবই কমন একটি সাইবার হামলা।
কীভাবে ঘটে এই সাইবার হামলা?
ধরা যাক, জনাব “চাঁদ সওদাগর” কাজ করেন একটি টিভি চ্যানেলে। একদিন অফিসে তার চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি ইমেইলটা খুললেন কিছু নিউজ (টেক্সট, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি) ডাউনলোড করার জন্য। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খবর তিনি ডাউনলোড করে নিচ্ছেন। এর মধ্যে একটি ইমেইলে চাঁদ সাহেবকে একেবারে নাম ধরে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে তার কম্পিউটারের মেইনট্যানেন্স/আপডেট এর জন্য একটি ছোট সফটওয়্যার ইন্সটল করতে হবে। সফটওয়্যারের ফাইলটি ইমেইলে অ্যাটাচ করা থাকতে পারে, অথবা ইমেইলেই একটি লিংক দেওয়া থাকতে পারে। চাঁদ সাহেব সরল বিশ্বাসে ইমেইলে পাওয়া লিংকে ক্লিক করে ফাইলটি ডাউনলোড করলেন এবং কম্পিউটারে ইন্সটল করলেন। ব্যস, খেল খতম।
ইমেইলে পাঠানো এই ফাইলটিই ছিল Malware; পাঠিয়েছিল কোন হ্যাকার। চাঁদ সাহেব নিজের অজান্তেই টোপ গিলেছেন হ্যাকারের। এখন কী হবে? অনেক কিছুই হতে পারে। যদি খুব সাধারণ মানের Malware হয় তাহলে চাঁদ সাহেব বড়জোর অদ্ভুত কিছু মেসেজ পাবেন; অথবা এই Malware টি নিজেকে রেপ্লিকেট করে নেটওয়ার্কের অন্য কম্পিউটারেও ছড়িয়ে যাবে।
এর বেশি আর কী ক্ষতি করতে পারে?
চাঁদ সাহেবের কম্পিউটারের কন্ট্রোল নিয়ে নিতে পারে হ্যাকার। ঐ কম্পিউটারের যাবতীয় ফাইল কপি করে নিতে পারে।
আর কী ক্ষতি করতে পারে ?
অফিসের নিজস্ব কিছু অটোমেশন সিস্টেম/সফটওয়্যার থাকে। চাঁদ সাহেব যেহেতু অফিসের একজন কর্মী, তারও নিশ্চয়ই ঐ সিস্টেমগুলোতে প্রবেশাধিকার ছিল। চাঁদ সাহেবের কম্পিউটার ব্যবহার করে ঐ সিস্টেমে ঢুকে পড়তে পারে হ্যাকার। আর যদি চাঁদ সাহেবের প্রবেশাধিকার থাকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ লেভেলের গুরুত্বপূর্ণ কোন সিস্টেমে, তাহলে বুঝতেই পারছেন কী হতে পারে!
হ্যাকার যদি আরো বেশি দুষ্টু হয় তাহলে ঐ Malware দিয়ে চাঁদ সাহেবের কম্পিউটার সহ পুরো অফিস এবং সব সিস্টেমের ফাইলগুলো এনক্রিপ্ট/লক করে দিতে পারে, মানে অফিসের কোন ফাইল আর কেউ ওপেন করতে পারবে না। ঐ ফাইলগুলো ডিক্রিপ্ট বা আনলক করতে চাইলে হ্যাকারের সাহায্যই নিতে হবে। তবে এমনি এমনি তো আর সে সাহায্য করবে না, তাই না? এত খাটনা-খাটনি করেছে সে! আপনি খুশি (!) হয়ে পঞ্চাশ লাখ ডলার (কম-বেশিও হতে পারে) তার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিবেন, সে আনলক করে দিবে।
এই যে Malware দিয়ে Ransom (মুক্তিপণ) চাইলো, এই সাইবার অ্যাটাককে বলা হয় Ransomware; নাম অবশ্যই শুনে থাকবেন। একবার যদি Ransomware হামলা করতে পারে তাহলে সাধারণত টাকা দিয়েও ফাইল উদ্ধার করা যায় না।
আপনি ভাবছেন হ্যাকারের অ্যাকাউন্টে টাকা দিয়েছেন, পুলিশের সাহায্যে খুব সহজেই তাকে ট্র্যাক করে ধরে ফেলবেন? ব্যাপারটা এত সহজ নয়। হ্যাকার সাধারণ কোন অ্যাকাউন্টে টাকা নিবে না। সে ডার্ক ওয়েবে (ইন্টারনেটের অন্ধকার জগত; এটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো) কোন এক অ্যাকাউন্টে টাকা নিবে। আর সে বাংলা টাকা বা ডলারে নিবে না। সে নিবে ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন বিটকয়েন; এই বিষয়ে আরেকদিন লেখা দিব) ফরম্যাটে। আপনি না পারবেন তাকে ট্র্যাক করতে, না পারবেন তাকে দেওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে। এত ভেজাল হতো না যদি চাঁদ সাহেব আরেকটু সচেতন হতেন, যদি লিংকে ক্লিক করে অথবা ইমেইল অ্যাটাচমেন্টটি ডাউনলোড করে ইন্সটল না করতেন!
কিন্তু, সচেতন হলেই কি হামলা এড়ানো সম্ভব ?
ধরা যাক, চাঁদ সওদাগরের পাশের ডেস্কে কাজ করেন অতি সচেতন “সুরুজ সওদাগর”। সুরুজ সাহেবকে হ্যাকার ঠকাতে পারে না; তিনি কোন ভুয়া লিংকে ক্লিক করেন না; ডাউনলোড করা ফাইলে ডাবল ক্লিক করেন না।
একদিন সুরুজ সাহেবের কম্পিউটারে কোন এক শিল্পীর বায়োডাটা আসলো। সুরুজ সাহেব দেখলেন ইমেইলের বডিতে সুন্দর করে তাকে নাম ধরে “স্যার” ডেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে সিভিটা দেখার জন্য। অ্যাটাচ করা পিডিএফ ফাইলটা ডাউনলোড করলেন তিনি; পিডিএফটা ওপেন করার জন্য ক্লিক করলেন দুইবার। খেল খতম সুরুজ সওদাগরের।
আসলে দেখতে পিডিএফ এর মতো হলেও ফাইলটা পিডিএফ ফাইল ছিল না। এটা একটা Malware-ই ছিল, শুধু আইকনটা পিডিএফ এর মতো করে দিয়েছিল হ্যাকার। চাঁদ-সুরুজ দুজনেই কুপোকাত, রাতের আকাশের তারা দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই এখন।
এ তো গেল Malware বা Ransomware হামলার কাহিনী। আরো অনেক ধরণের সাইবার হামলা আছে। হ্যাকাররা লাইভ ব্রডকাস্টে হামলা করতে পারে। লাইভ কনটেন্ট বন্ধ বা পরিবর্তন করতে পারে। ব্রডকাস্টার এর সিস্টেমে ক্রমাগত সার্ভিস রিকোয়েস্ট দিয়ে সিস্টেম ডাউন রাখতে পারে (DoS/DDoS হামলা; এসব হামলার বিষয়ে আরেকদিন কথা হবে)। চুপিসারে ব্রডকাস্টারের গোপনীয় কন্টেন্ট বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরি করে নিতে পারে।
কেন ব্রডকাস্টার বা মিডিয়া চ্যানেলে সাইবার হামলা হয় ?
লেখার শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার Channel 9-এ যে হামলার খবরটি দিয়েছিলাম, এর আগে বা পরে আরো অনেক ছোট-বড় সাইবার হামলা হয়েছে। যেমন ২০১৩ সালে টানা চার মাস ধরে New York Times এর কম্পিউটার সিস্টেমে সাইবার হামলা চালায় হ্যাকাররা। প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে রিপোর্টার এবং অন্যান্য কর্মীদের পাসওয়ার্ড চুরির চেষ্টা করে। এর জন্য দায়ী করা হয় চায়নিজ হ্যাকারদের। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের একটি টিভি চ্যানেল “TV5Monde” হ্যাকারদের ভয়াবহ হামলার শিকার হয়। এই হামলার জন্য দায়ী করা হয় রাশিয়ান হ্যাকারদের একটি গ্রুপকে।
ব্রডকাস্টাররা হ্যাকারদের প্রাইম টার্গেটে পরিণত হবার অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, অনেক ব্রডকাস্টার এর কাছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল থাকে, দুষ্প্রাপ্য ভিডিও বা সংবাদ থাকে। এগুলো দখলে নিয়ে অর্থ দাবী করা একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। গোপনীয় ফুটেজ নিরাপত্তা বিঘ্ন করার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। দেশে অস্থিরতা এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে হ্যাকাররা আক্রমণ করতে পারে।
অনেক সময় হ্যাকারদের আক্রমণের পেছনে আর্থিক কোন চাহিদা থাকে না, তারা শুধু নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানান দিতে চায়। The Dark Knight মুভিতে জোকার ব্যাংক লুটের সব টাকা জড়ো করে টাকার স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর কারণ হিসেবে আলফ্রেড ব্যাটম্যানকে বলেছিল “Some men aren’t looking for anything logical, like money. They can’t be bought, bullied, reasoned, or negotiated with”. কিছু হ্যাকারের উদ্দেশ্য এরকমই, তারা দেখাতে চায় তাদের সামর্থ্য (যারা মুভিটা দেখেননি তারা ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান ট্রিলজি দেখতে পারেন)।
সাধারণ কোন অফিসে সাইবার হামলার বদলে যদি মিডিয়াতে হামলা চালানো হয় তাহলে খুব দ্রুতই সে হামলার খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে ব্রডকাস্টারের রেপুটেশন যেমন নষ্ট হয় তেমনি সেবা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে ব্রডকাস্টারদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং ব্যবহৃত ডিভাইসও উন্নত এবং জটিল হচ্ছে। অনেক সময় এই জটিল সিস্টেমগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগ করা হয় না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে যে কোন হ্যাকার। একেবারে সাধারণ কারিগরী জ্ঞানসম্পন্ন লোকও এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
অনেক হামলার পেছনে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ইস্যুর চেয়েও বড় কারণ থাকতে পারে। যেমন, কোন এক দেশের হ্যাকাররা সাইবার হামলা চালাতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সরকারি-বেসরকারি আইটি স্থাপনায়। দুই দেশের যুদ্ধটা তখন আর মাঠে থাকে না, সাইবার জগতে চলে। এরকম বহু নজির রয়েছে।
সাইবার হামলা প্রতিরোধে ব্রডকাস্টারদের করণীয় কী?
Prevention is better than cure. সাইবার হামলা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও তাই। ডাটা এনক্রিপশন করে ফাইল ট্রান্সফার করতে হবে; মানে ফাইল যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে, হ্যাকারের উঁকি মেরে দেখার সুযোগ থাকবে না যে ফাইলের বিষয়বস্তু কী। ইন্টারনাল এবং এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন এর যে লিংক ব্যবহার করা হয় (যেমন স্যাটেলাইট লিংক, ট্রান্সমিশন লিংক, ক্লাউড স্টোরেজ ইত্যাদি) তা Secured Broadcasting Network হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ব্যবহৃত সকল সফটওয়্যার (এবং হার্ডওয়্যার)-এর লাইসেন্স আপডেট, প্যাচ আপডেট করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সকল ব্যবহারকারীকে সম্ভাব্য সাইবার হামলার ধরণ এবং এ ধরণের হামলা মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
উন্নত এবং আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডিভাইসসমূহে উন্নত সাইবার সিকিউরিটি ফিচার (যেমন Artificial Intelligence এবং Machine Learning, Content Integrity-র জন্য Blockchain, Cloud Based System এর জন্য Cloud Security ইত্যাদি; এগুলো নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত বলবো) ব্যবহার করতে হবে। দক্ষ আইটি পেশাজীবীদের দ্বারা এই উন্নত ফিচারসমূহের নিয়মিত মনিটরিং এবং কনফিগারেশন পর্যালোচনা করতে হবে। সর্বোপরি, ব্রডকাস্টারদের জন্য উপযুক্ত সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা প্রস্তুত করে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
শেষ কথা
তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে অবহেলার কোন সুযোগ নেই। যে কোন মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এবং ব্রডকাস্টারের বেলায় শতভাগ সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য দক্ষ আইটি পেশাজীবীদের মাধ্যমে আইটি নির্ভর সাইবার সিকিউরিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র রাখতে এখনই সময় একটি যুগোপযুগী পরিকল্পনার যা সাইবার সুরক্ষায় আমাদের এক ধাপ এগিয়ে রাখবে সবসময়ই।